কার জন্য অঝোরে কাঁদল লুঝনিকির আকাশ?

ফাইনালের শেষ বাঁশি বেজেছে অনেক আগেই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বাঁধনহারা উল্লাস-উদযাপনের প্রথম পর্বও সেরে ফেলেছেন ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা। তো সেই আনন্দনৃত্যে সাময়িক বিরতি দিয়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা তখন পুরস্কার বিতরণীপর্বের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় শিরোপা স্বপ্নভঙ্গ হওয়া ক্রোয়েশিয়ানরাও। কিন্তু পুরস্কার বিতরণী আর শুরু হয় না। বিশ্বকাপের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার দেবেন বিশ্বনেতারা। প্রস্তুতি সারতে বিলম্ব তো হবেই! অবশেষে প্রস্তুতি বিলম্ব শেষে পুরস্কার বিতরণী যখন শুরু হলো, ঠিক তখনই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে নামল বৃষ্টির ঝর্নাধারা।

তা পুরস্কার বিতরণপর্বে কার জন্য এমন অঝোরে কাঁদল লুঝনিকির আকাশ? পরাজিত ক্রোয়েশিয়ানদের চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্য? নাকি ফরাসিদের বিশ্বকাপজয়ী উদযাপনকে ধুয়ে মুছে পুতপবিত্র করার জন্য?

মাত্র ৪৫ লাখ জনসংখ্যার দেশ ক্রোয়েশিয়ার ২৩ ফুটবল সৈনিক রাশিয়ায় অবিশ্বাস্য ফুটবলশৈলী উপহার দিয়ে বিশ্ববাসীর মন জয় করে নিয়েছে। আগের ৬ ম্যাচেই জিতে যোগ্যতর দল হিসেবেই প্রথমবারের মতো উঠেছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে।

রোববার লুঝনিকির ফাইনালেও দুর্দান্ত ফুটবলই উপহার দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু এ দিন ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। ভাগ্য আর ফরাসি ট্যাকটিকসের কাছে হার মানতে হয়েছে তাদের। কাঁদতে হয়েছে তীরে এসেও শিরোপা-স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায়।

কিন্তু ক্রোয়াটদের সেই কান্না বুঝি সহ্য হচ্ছিল না বৃষ্টিদেবতার। তাই হয়তো ক্রোয়াটদের চোখের জল ধুয়ে দিতে লুঝনিকিতে নামালেন বৃষ্টিধারা। যে বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হলো ক্রোয়াটদের স্বপ্নভঙ্গের তপ্ত হৃদয়।

কিংবা লুঝনিকির আকাশ হয়তো কাঁদল চ্যাম্পিয়ন ফরাসিদের জন্যই। ফেভারিট পতনের বিশ্বকাপে শেষ পর্ন্ত ফেভারিট তকমার মান রক্ষা করেছে ফ্রান্স। অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল ফ্রান্স। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ গ্রুপপর্ব থেকেই যেভাবে ফেভারিটদের বাড়ি পাঠানোর মিশনে নেমেছিল, তা দেখে ফরাসিদের অন্তরাত্মাও হয়তো কেঁপেছে। তবে শেষপর্যন্ত সেই কাঁপন জয় করে যোগ্যতর দল হিসেবেই দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় তুলেছে ফ্রান্স।

এই যে দীর্ঘ একটি মাস ধরে লড়াই-সংগ্রাম, ঝাম ঝরানোর পর শিরোপা উদযাপন, সেই উদযাপনকে পুতপবিত্র করতে হবে না! বৃষ্টির ঝর্নাধারা বইয়ে বৃষ্টি দেবতা তাই হয়তো ফরাসিদের শরীরের ঘাম ধুয়ে দিয়ে শিরোপা উদযাপনটা শেতশুভ্র বানিয়ে দিল!

যাই হোক, হঠাৎ লুঝনিকির আকাশ ভেঙে নামা বৃষ্টিধারার মধ্যেই চলল পুরস্কার বিতরণীপর্ব। বৃষ্টির ফোঁটায় শীতল হতে হতেই পুরস্কার বিরতণ করলেন ফিফা সভাপতি ইনফানতিনো, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্ব নেতারা। যে পুরস্কার বিতরণীতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভিজলেন ফ্রান্স এবং ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টও।

বৃষ্টিতে ভিজেই সোনার মেডেল গলায় তুললেন ফরাসি খেলোয়াড়েরা। পরম আরাধনার ট্রফিটা হাতে পেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেই চলল ফরাসিদের দ্বিতীয় দফা শিরোপা উদযাপন। বৃষ্টিতে ভিজেই গ্রিজমান, এমবাপে, পগবা, মাতুইদি, উমদিতি, ভারানেদের সেই বিশ্বজয়ী উদযাপনের স্বাক্ষী হলো লুঝনিকির গ্যালারি ভর্তি দর্শকেরা। পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমে তপ্ত শরীরটাও করেছে শীতল।

ও হ্যাঁ, ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়, গ্যালারিভর্তি দর্শক-সবার জন্য আশির্বাদ হয়ে নামা বৃষ্টিতে ধৌত হওয়া পুরস্কার বিরতণী পর্বে দৃষ্টিকটু একটা দৃশ্যও ঘটে গেল। প্রথমত বৃষ্টিতে ভিজছিল মঞ্চে উপস্থিত বিশ্ব বরেণ্য সব ব্যক্তিরাই। বৃষ্টির ফোটাতে ভারি হতেই হঠাৎ মঞ্চে আভির্ভাব হলো একটি ছাতার।

পেছনে দাঁড়িয়ে এক সহকারী সেই ছাতা ধরলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মাথার উপর। নিজেদের দেশের প্রেসিডেন্টকে বৃষ্টিতে ভেজা থেকে বাঁচালেন। কিন্তু ফিফা সভাপতি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টসহ মঞ্চে উপস্থিত অন্য সবাই ভিজলেন। কিছুক্ষণ পর অবশ্য সবার মাথার উপরই ছাতা উঠল। কিন্তু ততক্ষণে পোষাক-শরীর ভিজে চুপচুপে।

বৃষ্টির ফোঁটা পেল না শুধু স্বাগতিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান দুই ব্যক্তির একজন। সবাইকে বৃষ্টিতে রেখে নিজের উপর ছাতা উঠিয়ে সেই ক্ষমতার প্রভাবই কি দেখালেন পুতিন!

নয়তো মঞ্চে অন্য যারা ছিলেন, তারা সবাই তো ছিলেন তার অতিথি। নিজে ভিজে অতিথিদের রক্ষা করাই কি উচিত ছিল না তার! অথচ তিনি করলেন উল্টো কাণ্ড। অতিথিরা যে ভিজছেন, সে দিকে তার খেয়ালই নেই। ছাতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে তিনি নিঃসংকোচে দিয়ে গেলেন পুরস্কার।

দলের খেলোয়াড় এবং দর্শকদের তপ্ত হৃদয়ই শুধু সিক্ত করেনি, হঠাৎ নামা বৃষ্টি দুই ক্ষমতাবানের স্বার্থবাদী মনোভাবকেও ফুটিয়ে তুলল আপন মহিমায়!